বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হলেও কার্যপ্রণালি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, এটি আমাদের শ্বেতপত্রেও সুপারিশ ছিল। তবে যেভাবে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। তার মতে, কোনো আলোচনা ছাড়া পেশাজীবীদের ভূমিকা সংকুচিত করে এবং স্বায়ত্তশাসিত কাঠামো আরও নিয়ন্ত্রণে এনে বিভাজন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এনবিআরের কার্যকর ও সুষ্ঠু বিভাজন নিশ্চিত করা। সোমবার (১৯ মে) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘নীতি সংস্কার ও আগামীর জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত সংলাপে এসব মন্তব্য করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময় যারা চোরতন্ত্র বা লুটপাটতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদরা এখন পালিয়ে রয়েছেন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নির্জীব হয়ে পড়েছে, অথচ আমলারা আবারও সক্রিয়ভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন।অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি সরকারের মনোযোগ কম উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের সাধারণ অভিযোগ হলো—সরকার অন্যান্য খাতে সংস্কারে যতটা মনোযোগ দেয়, অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সেই মনোযোগ দেখা যায় না। এটি একটি বড় সমস্যা, যা সরকার অনুধাবন করছে না। অর্থনীতিতে স্বস্তি না থাকলে অন্য কোনো খাতের সংস্কারও টেকসই হবে না।বাজেটে নানা অসংগতি ও অসম্পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও সেটি কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা চারটি প্রধান বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বলে মন্তব্য করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে চলমান আলোচনা কী ফল বয়ে আনে, নির্বাচনের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা পাওয়া যায় কি না, বিচার প্রক্রিয়া আগে হবে নাকি পরে—এই প্রশ্নগুলোর পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতাও বাজেট বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে | অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে কলমবিরতি পঞ্চম দিনে পৌঁছায়। এতে রাজস্ব খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার পর অচলাবস্থা নিরসনে এবার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মঙ্গলবার (২০ মে) দুপুরে সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন উপদেষ্টা ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। এই আলোচনাকে স্বাগত জানিয়ে আন্দোলনকারীরা তাদের কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন। গতকাল সোমবার কলমবিরতির পর এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় ঐক্য পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ সময় ঐক্য পরিষদ তিনটি প্রধান দাবি তুলে ধরে। দাবিগুলো হলো—অবিলম্বে জারি করা অধ্যাদেশ বাতিল; এনবিআর পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ওয়েবসাইটে প্রকাশ; এবং এনবিআরের প্রস্তাবিত খসড়া ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুধীসমাজ, ব্যবসায়ী সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে একটি টেকসই ও উপযুক্ত সংস্কার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।দীর্ঘদিন ধরে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশ সম্পর্কে অজ্ঞতায় ছিলেন, যা তাঁদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। এর প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়েও। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। কিন্তু আন্দোলনের প্রস্তুতি ও চলমান কর্মসূচির প্রভাবে মে মাসের প্রথম ১৮ দিনে আদায় হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। এই গতি বজায় থাকলে পুরো মে মাসে রাজস্ব আদায় দাঁড়াতে পারে মাত্র ১৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকায়, যেখানে গত বছরের মে মাসে আদায় হয়েছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় চলতি মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে শুধু প্রথম ১৮ দিনেই প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এত বড় ক্ষতির পর সরকার অবশেষে উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে।সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করে এবং সংস্কার কমিটির সুপারিশ প্রকাশ না করেই নজিরবিহীন দ্রুততা ও গোপনীয়তার মধ্যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এবং এর উদ্দেশ্য নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গন, ব্যবসায়ী মহল, নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পক্ষ প্রশ্ন তুলেছে। বক্তারা বলেন, রাজস্বব্যবস্থার সংস্কারের নামে ৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এনবিআরকে বিনা কারণে বিলুপ্ত করা হয়েছে। যেখানে প্রয়োজন ছিল এনবিআরকে সংস্কারের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করা, সেখানে তার বদলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করে রাজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও রীতিনীতির পরিপন্থী।