তৈরি পোশাক নির্ভরতা থেকে এখনই বের হওয়ার  সময়

রপ্তানি ঝুঁকিতে অর্থনীতি

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে একটি মাত্র খাত থেকে, তৈরি পোশাক (RMG)। এই একমুখী নির্ভরতা দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতির নীরব ঝুঁকি হয়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর সেই ঝুঁকি এখন স্পষ্ট এবং তাৎক্ষণিক বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।

বিশ্ববাজারে যেকোনো বৈদেশিক চাপ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা অর্থনৈতিক মন্দা যদি RMG খাতকে ধাক্কা দেয়, তাহলে পুরো রপ্তানি খাত, এমনকি জাতীয় অর্থনীতিও কেঁপে ওঠে। এই মুহূর্তে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত- আমরা কি শুধু একটি খাতের উপর এতটা নির্ভরশীল থাকতে পারি?

রপ্তানি চিত্র: এক চোখে দেখা
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৫৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যা মোট রপ্তানির ৮২ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ আয় এসেছে প্রায় এক ডজন খাত থেকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য: ৯০০ মিলিয়ন ডলার, পাট ও পাটজাত পণ্য: ৮০০ মিলিয়ন ডলার, ওষুধ শিল্প: ২০০ মিলিয়ন ডলার, আইসিটি ও সফটওয়্যার: ৬০০ মিলিয়ন ডলার, হিমায়িত মাছ ও চিংড়ি: ৫০০ মিলিয়ন ডলার, সিরামিক, হালকা প্রকৌশল, জাহাজ নির্মাণ: ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার (সমষ্টি)। এই সংখ্যাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- আমরা যেসব খাতকে সম্ভাবনাময় বলে জানি, তারা এখনো বাস্তবতা থেকে বহু দূরে।

সম্ভাবনা ছিল, বাস্তবায়ন হয়নি
একটা সময়ে বাংলাদেশের ওষুধ খাত নিয়ে বিশ্বে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। দেশের বেশ কিছু কোম্পানি GMP মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করে, যেগুলো আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বাজারে জনপ্রিয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থার (যেমন US FDA, EMA) অনুমোদন ও বিপণন নেটওয়ার্কের ঘাটতির কারণে এখনো এই খাত বছরে মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। অথচ ভিয়েতনাম বা ভারত একই খাত থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও অবস্থান একই। ৬০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার নিয়ে বাংলাদেশ এখনো বিদেশি আউটসোর্সিং বাজারে ছোট খেলোয়াড়। হিমায়িত চিংড়ি, চামড়াজাত পণ্য, পাট সবখাতেই একই ছবি।

এর পেছনে কারণ একাধিক। নৈতিকভাবে আরএমজি খাতকে বর্ধিত সুবিধা দেওয়া হয়েছে, অথচ অন্য খাতগুলো অবহেলিত থেকেছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি, আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্মত পণ্য সরবরাহের অক্ষমতা, এবং সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের দৃষ্টি ও পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা অন্য খাতগুলোকে গতিশীল হতে দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক: আগুনে ঘি
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যা এই একটি দেশ থেকেই মোট পোশাক রপ্তানির ২৩ শতাংশ। এখন যদি এই রপ্তানির উপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক পণ্য হবে আরও ব্যয়বহুল ভিয়েতনাম, মেক্সিকো কিংবা মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায়।
এর প্রভাব হতে পারে বহুমাত্রিক: রপ্তানি হ্রাস পেয়ে বছরে ২/৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমে যেতে পারে, ৩/৫ লক্ষ শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে, রপ্তানি কমলে ডলারের সরবরাহ কমবে, রিজার্ভে চাপ পড়বে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে চলে যেতে পারে। এই সংকট শুধুই পোশাক শিল্পের নয়, এটি গোটা অর্থনীতির।

এক খাতনির্ভরতার অবসান চাই এখনই
আজকে আমাদের বুঝতে হবে, রপ্তানিতে টিকে থাকতে হলে আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে, এবং তা আর বিলম্ব নয়, এখনই করতে হবে।

কী করা দরকার?
১. অ-আরএমজি খাতের জন্য প্রণোদনা সমতা: যেমন নগদ সহায়তা, কর ছাড়
২. FTA ও PTA এর মাধ্যমে নতুন বাজারে প্রবেশ
৩. রপ্তানি ঋণ সহায়তা সংস্থা (Export Credit Agency) প্রতিষ্ঠা
৪. ‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ গঠন, যেখানে শুধু পোশাক নয়; ফার্মা, প্রযুক্তি ও হালাল খাদ্য পণ্যকেও তুলে ধরা হবে
৫. প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে একটি ‘রপ্তানি বহুমুখীকরণ কাউন্সিল’ গঠন, যার লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকবে, এবং অগ্রগতি নিয়মিত পর্যালোচিত হবে, এবং অগ্রগতি নিয়মিত পর্যালোচিত হবে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প তৈরি পোশাক শিল্পের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন সময় এসেছে নতুন খাতের উপর ভরসা গড়ে তোলার। আমরা যদি সংকটকেই সম্ভাবনায় রূপ দিতে পারি, তাহলেই এই শুল্ক আমাদের জন্য ঝুঁকি নয়, বরং রপ্তানির নবযাত্রার সূচনা হতে পারে।

সুত্র ঃ ডা. . রমিজ উদ্দিন চৌধুরী,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *