শিল্প প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে ঋণের মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ

ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশেষ নীতি সহায়তা ঘোষণা করেছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে লাভজনক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলেছিল।

এই নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হবে না। তবে সংশ্লিষ্টে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন অবশ্যই নিতে হবে। এই নতুন নীতি সহায়তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন করে তাদের টেকসই ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন ব্যাংকের ঋণ আদায় নিশ্চিত হবে, তেমনি অন্যদিকে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নতুন গতি সঞ্চার হবে।

কারা পাবে এই সুবিধা?

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণ বা অব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেমন—রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈষম্যের শিকার হওয়া, প্রতিশ্রুত ইউটিলিটি সংযোগ না পাওয়া, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বিঘ্ন কিংবা টাকার অপ্রত্যাশিত অবমূল্যায়ন, তারা এই সুবিধার আওতায় আসবে। তবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আগে কোনো ধরনের পুনঃ তফসিল বা পুনর্গঠন সুবিধা গ্রহণ করেনি, তারা এই ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। এই সুবিধা পেতে ঋণগ্রহীতাদের আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে হবে এবং ব্যাংকগুলোকে ছয় মাসের মধ্যে আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে।

বিশেষ পুনঃ তফসিল সুবিধা

নতুন নীতিমালায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বিরূপমানে (যেমন—সাবস্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল, ব্যাড লস) থাকা ঋণগুলো ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদে পুনঃ তফসিল করা যাবে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দুই বছর গ্রেস পিরিয়ড বা কিস্তি পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

পুনঃ তফসিলের জন্য ঋণগ্রহীতাকে বিদ্যমান ঋণস্থিতির কমপক্ষে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিতে হবে। যারা তিন বা তাঁর বেশিবার ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ডাউনপেমেন্টের হার ১ শতাংশ বেশি হবে। পুনঃ তফসীলকৃত ঋণের সুদের হার গ্রাহকভেদে নির্ধারিত হবে, যা নীতিমালায় উল্লিখিত সর্বনিম্ন হারের চেয়ে ১ শতাংশ কম হবে।

কিস্তিগুলো মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরিশোধযোগ্য হবে। গ্রেস পিরিয়ডে আরোপিত সুদ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আদায় করা যাবে।

অন্যান্য বিধান

নতুন ঋণসুবিধা : এই নীতি সহায়তার আওতায় ঋণগ্রহীতা তাদের কম্প্রোমাইসড অ্যামাউন্ট প্রদান না করেও নতুন ঋণসুবিধা বা বিদ্যমান ঋণসীমা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। তবে নতুন ঋণ মঞ্জুরের আগে গ্রাহকের অতীত লেনদেনসহ সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে।

মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন: ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত অশ্রেণীকৃত মেয়াদি ঋণ সর্বোচ্চ দুই বছর বাড়িয়ে পুনর্গঠন করা যাবে। এ ছাড়া বিশেষ এক্সিট সুবিধার আওতায় নিয়মিত ঋণেও অতিরিক্ত এক বছর সময় দেওয়া যাবে।

ডলারের ক্ষতিপূরণ: ২০২২ সালে আমদানি করা ইউজেন্স এলসির বিপরীতে মুদ্রাবিনিময় হারের অপ্রত্যাশিত ক্ষতির কারণে সৃষ্ট অতিরিক্ত ব্যয় ব্যাংক নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় হিসাব করবে এবং গ্রাহক-ব্যাংকার সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধে সময় দেবে।

ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদন: এই নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হবে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন অবশ্যই নিতে হবে।

আন্ত ব্যাংক সমন্বয় : যেসব ঋণগ্রহীতার ঋণ ৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি, তাদের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যাংকের সমন্বয় আন্ত ব্যাংক সভায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব না হয়, তবে বিষয়টি ‘নীতি সহায়তা বাছাই কমিটি’তে পাঠানো হবে।

যেসব ক্ষেত্রে নীতি সহায়তা মিলবে না

নীতিমালায় কিছু ব্যতিক্রমও রাখা হয়েছে। জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষিত ঋণে এবং পরিচালক বা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণে এই সুবিধা দেওয়া হবে না, যদি না বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন থাকে। পুনঃ তফসিল বা পুনর্গঠনকৃত ঋণগুলোকে এসএমএ (স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট) হিসেবে শ্রেণীকৃত করতে হবে এবং যথাযথ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।

এনডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *