বাংলাদেশের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে সাধারণ সিপাই পদে চাকরি শুরু করেছিলেন মোঃ সারওয়ার হোসেন (নয়ন)। ২০২৫ সালের ৫ মার্চ তিনি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান এবং বর্তমানে কর্মরত আছেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (পশ্চিম)-এ। সরকারি চাকরিতে থেকে তিনি কীভাবে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হলেন, কীভাবে স্থানীয়ভাবে ভয়-ভীতি, জমি দখল, কৃষকদের জিম্মি করা ও অর্থ আত্মসাতের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন—তা এখন তদন্ত সংস্থাগুলোর আলোচনায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
দুদক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ: আয়–ব্যয়ের অসামঞ্জস্য যাচাই, তদন্ত, দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা।
অবৈধ সম্পদ: শত কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট, বহুতল ভবন, নগদ অর্থ।
জমি দখল কৌশল: মূল দলিল ও কাগজপত্র জিম্মি রাখা, নন–জুডিশিয়াল
স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর, ফাঁকা ব্যাংক চেক নেওয়া।
স্থানীয় প্রভাব: গ্রামে ভয়, মানুষকে জিম্মি করা, “নয়ন বাহিনী” পরিচালনা।
দুর্নীতি ও চোরাচালান: বিমানবন্দর থেকে বিদেশি পণ্য ও স্বর্ণ চোরাচালান।
সারওয়ার হোসেন (নয়ন) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, কর্মস্থলের সুযোগ নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিদেশি পণ্য ও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। এসব অপকর্মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেন এবং নাম ও বেনামে জমি, ফ্ল্যাট, বহুতল ভবন ও বিপুল সম্পদের মালিক হন ও অর্থ ও প্রভাব ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে “নয়ন বাহিনী” নামের একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। গ্রাম–গঞ্জে সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে দলিল, ব্যাংক চেক ও নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সই নিয়ে তাদের জমি কম দামে দখল করেন।
তথ্যানুযায়ী, নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলায় মনিয়ারী ও বিশা ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় সারওয়ার হোসেনের নামে ও বেনামে অন্তত ১২০ বিঘার বেশি জমি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ (১) . দমদত্তবাড়িয়া মৌজায় ৪৫ বিঘার বেশি জমি। (২) . হিঙ্গুলকান্দি মৌজায় ১৫ বিঘা। (৩). বাহাদুরপুর মৌজায় ১৮ বিঘা। (৪). তেজনন্দী মৌজায় ২৫ বিঘা। (৫). লালপাড়া মৌজায় ১৭ বিঘা। শুধু তাই নয়, রাজধানী ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও বহুতল ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। গ্রামের মানুষদের দাবি, তিনি নিয়মিত বলেন, আমার প্রতিদিন ৮–১০ লাখ টাকা আয় হয়।
অভিযোগ রয়েছে, নিজের অবৈধ অর্থ আড়াল করতে সারওয়ার হোসেন তার পিতা আজিম উদ্দিন সোনার, ভাই আনোয়ার হোসেন (সেন্টু), মিজানুর রহমান (মিন্টু) ও আবুল কালাম আজাদের নামেও জমি ক্রয় করেছেন। দমদত্তবাড়িয়া, হিঙ্গুলকান্দি, বাহাদুরপুর, নৈদিঘী, পৈসাওতা সহ বিভিন্ন মৌজায় খতিয়ানভুক্ত জমি তার প্রভাব ও অর্থের জোরে দখল করেছেন। এছাড়া নিজের চাচা জসিম উদ্দিন, জহির উদ্দিন ও আমজাদ উদ্দিনের জমি ক্রয় করেও এখনো নামজারি করেননি। ফলে প্রকৃত মালিকরা আজ অবধি তাদের জমি থেকে বঞ্চিত। জানা গেছে, গ্রামের সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে সারওয়ার হোসেন যে কৌশল ব্যবহার করেছেন (১). মূল দলিল ও জমির কাগজপত্র নিজের কাছে জিম্মি রাখা। প্রতিটি জমির জন্য মাত্র ১ লক্ষ টাকা দিয়ে ৫টি করে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করানো এবং ফাঁকা ব্যাংক চেক নেওয়া। পরবর্তীতে কৃষকদের বিপদে ফেলে অল্প মূল্যে জমি ক্রয় দেখানো।
ভুক্তভোগীরা জানান, এভাবে শতাধিক বিঘা জমি তিনি নিজের করে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, তারা জীবনভর সঞ্চিত সম্পত্তি হারিয়েছেন। সারওয়ার হোসেনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে অনেক কৃষক দিশেহারা। কেউ হারিয়েছেন দাদার সম্পত্তি, কেউ আবার ভিটেমাটি পর্যন্ত হারানোর আশঙ্কায় আছেন। অনেকের অভিযোগ, দলিল ফিরিয়ে না দেওয়ার কারণে তারা ব্যাংক ঋণ বা অন্য আর্থিক সুবিধা নিতে পারছেন না।
গ্রামের প্রবীণ আব্দুর রহমান বলেন, নয়ন সাহেব এখন এলাকার জন্য আতঙ্ক। টাকা আর ক্ষমতার জোরে তিনি মানুষের ভিটেমাটি কেড়ে নিচ্ছেন। আত্রাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে জানা যায়, সাধারণ মানুষ তাকে ভয় পান। কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পান না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাসিন্দা বলেন, নয়ন প্রতিদিনই বড় গাড়ি নিয়ে আসে, বাহিনী নিয়ে ঘোরে। টাকা দিয়ে সব চুপ করিয়ে দেয়। আমরা ভয়ে কিছু বলি না। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে সারওয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে তার আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্য ও বিপুল জমি কেনার প্রমাণ মিলেছে। দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলার মতো পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে। তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে, স্থানীয় আদালতে কৃষকদের পক্ষ থেকে মামলা ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে অনেক জমি এখন আইনি জটিলতায় রয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রুবিনা সুলতানা বলেন, একজন সরকারি কর্মচারীর এ ধরনের সম্পদ অর্জন স্পষ্টতই দুর্নীতি। দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত দ্রুত তদন্ত শেষ করে ব্যবস্থা নেওয়া ও সামাজিক বিশ্লেষক ড. সাইফুল হক বলেন, গ্রামাঞ্চলের কৃষিজমি দখল করে প্রভাবশালী শ্রেণি ধনী হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। সারওয়ার হোসেনের ঘটনা সেই প্রবণতারই প্রতিফলন। ভুক্তভোগীরা আরো অভিযোগ করেছেন, সমসপাড়া বাজারের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক লিমিটেড ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে সারওয়ার হোসেনের নামে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়। স্থানীয়দের মতে, তিনি প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেন। এই বিপুল লেনদেন স্থানীয় অর্থনীতিতেও কৃত্রিম প্রভাব ফেলছে। তার অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি “নয়ন বাহিনী” নামে একটি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এই বাহিনী স্থানীয়ভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এবং কেউ তার বিরোধিতা করলে হুমকি দেয়। ফলে গ্রামের মানুষ একপ্রকার জিম্মি হয়ে আছে।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি চাকরি ও দায়িত্বের সুযোগ নিয়ে এ ধরনের সম্পদ অর্জন করা চরম দুর্নীতি। আমরা সারওয়ার নয়নের সম্পদ, লেনদেন ও জমির তথ্য যাচাই করছি। প্রয়োজন হলে দুদকের সঙ্গে সমন্বয় করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এবিষয়ে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ সারওয়ার হোসেন নয়নের নিকট একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
কাস্টমস বিভাগের এক ক্ষুদ্র কর্মচারী থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া সারওয়ার হোসেন (নয়ন)-এর কাহিনি দুর্নীতি, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নগ্ন উদাহরণ। সরকারি বেতন-ভাতার বাইরে এত বিপুল সম্পদ কেবল চোরাচালান, ঘুষ ও জমি দখল ছাড়া সম্ভব নয় এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। দুদকের সক্রিয় পদক্ষেপ, প্রশাসনিক তদারকি এবং স্থানীয় জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ছাড়া এ ধরনের প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের লাগাম টানা কঠিন। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ন্যায়বিচার ও সাধারণ মানুষের ভরসা ফিরে আসবে।
সুত্র ঃ সংবাদ দিগন্ত