চট্টগ্রাম বন্দরে মঙ্গলবার মধ্যরাত হতে ফের কার্যকর বর্ধিত ৪১শতাংশ মাশুল

Spread the love

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আপত্তি সত্ত্বেও এক মাসের স্থগিতাদেশ শেষে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪১ শতাংশ বর্ধিত মাশুল কার্যকর হয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা একে ‘বন্দর বন্ধের ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করে তা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, বন্দর পরিচালনায় নতুন দায়িত্ব পাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে খুশি করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আলোচনা ছাড়াই ট্যারিফ কার্যকরের ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, জেটি, শেড ও টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় পুষিয়ে নিতে ৩৯ বছর পর ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থ ও হিসাব বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুস শাকুর স্বাক্ষরিত এক নোটিশে জানানো হয়, ১৫ অক্টোবর থেকে নতুন হারে ট্যারিফ কার্যকর হবে। বন্দরের তালিকাভুক্ত শিপিং এজেন্টদের তপশিলি ব্যাংকে নতুন হারে অর্থ সংরক্ষণ করে জাহাজ ছাড়পত্র (এনওসি) নিতে বলা হয়েছে।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বন্দরের ৫২টি সেবা খাতের মধ্যে ২৩টিতে সরাসরি নতুন ট্যারিফ প্রযোজ্য হয়েছে। গড়ে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে এসব মাশুল। বিশেষ করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং খাতে সবচেয়ে বেশি মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি ২০ ফুট কনটেইনারের ট্যারিফ ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা করা হয়েছে, অর্থাৎ প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি। আমদানি কনটেইনারে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানিকৃত কনটেইনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে। মাশুল, ভাড়া ও ফি ডলারের বিনিময়মূল্যে নির্ধারিত হওয়ায় ডলারের দর বাড়লে ট্যারিফও বাড়বে। কিছু সেবা খাতে মাশুল দ্বিগুণ থেকে চার গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি ২০ ফুট কনটেইনারে আমদানি ও রপ্তানিতে খরচ ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়বে, যা বহনযোগ্য নয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও ব্যবসায়ীদের চাপে তা এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানিয়েছেন, বন্দর প্রতি বছর রেকর্ড পরিমাণ আয় করলেও অপারেশনাল ব্যয় ও আধুনিকায়নের ব্যয় মেটাতে ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দরের মোট আয় ছিল ৫ হাজার ২২৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে নিট আয় ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। তার ভাষায়, ‘আগে প্রতি কেজি আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে বন্দর আদায় করত ৩২ পয়সা, এখন তা বেড়ে ৪৪ পয়সা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে মাত্র ১২ পয়সা বেড়েছে।’ তার দাবি, এ পরিবর্তনের প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে তেমন পড়বে না।

তবে ব্যবসায়ীদের আপত্তি অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া এক চিঠিতে বলেন, ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ ট্যারিফ নির্ধারণের সময় ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩০.৬১ টাকা, যা বর্তমানে ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে। তার ভাষায়, ‘ট্যারিফ না বাড়িয়েও বন্দরের আয় চার গুণ বেড়েছে। এর পরও ট্যারিফ বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়।’ তিনি আরও বলেন, এ ধরনের বৃদ্ধি আমদানি-রপ্তানির ব্যয় বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে।

চট্টগ্রাম বন্দর সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হলেও, তার নিজস্ব অর্থায়নে সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিপুল অর্থ সংরক্ষিত তহবিলে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত মাশুল আরোপের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তার মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়।

এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘মোংলা ও পায়রায় মাশুল বাড়ানো হয়নি, শুধু চট্টগ্রামে বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো খাতে ছয় গুণ পর্যন্ত মাশুল বাড়ানো হয়েছে। এই বাড়তি খরচ সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে।’ তার অভিযোগ, বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সেলিম রহমান বলেন, ‘২৯ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে বন্দরকে কখনো লোকসানে দেখিনি। তাহলে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর যৌক্তিকতা কোথায়?’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতিযোগিতা করি, নিউমার্কেটের সঙ্গে নয়। আমাদের খরচ প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে এমনিতেই বেশি।’

এশিয়ান-ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, মাশুল বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভোক্তা ও রপ্তানিকারকরা। শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন জানান, এখন একটি ২০ ফুট কনটেইনার রপ্তানি করতে ১০০ ডলারের বেশি অতিরিক্ত খরচ পড়ছে। তার মতে, ছোট রপ্তানিকারকদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।

বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মাশুল কার্যকর হলে ভিয়েতনামের তুলনায় খরচ তিন গুণ বাড়বে। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’ বেপজিয়ার জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘প্রতিযোগী দেশগুলো ব্যবসার খরচ কমাচ্ছে, আমরা বাড়াচ্ছি—এটা হতাশাজনক।’

বারভিডার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কাউকে লাভ করাতে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করা যাবে না। আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বলেন, ‘বিদেশে মার্কিন ট্যারিফ কমাতে তদবির করা হচ্ছে, আর দেশে বাড়ানো হচ্ছে—এটা কীভাবে হয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *